
মোঃ মাসুদ রানা, কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি :
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র কুমিল্লা। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর যোগাযোগের বিস্ময়কে একত্র করে রেখেছে এই জেলার রেলপথ। কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন ও লাকসাম জংশন—দুটি নাম যেন একে অপরের পরিপূরক। একদিকে প্রাচীন নগর কুমিল্লার প্রাণস্পন্দন, অন্যদিকে লাকসাম জংশন, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রেল যোগাযোগের হৃদপিণ্ড।
কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ আমলে, প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে। তৎকালীন সময়েই ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে কুমিল্লা হয়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। সেই থেকে আজও প্রতিদিন শত শত ট্রেন ছুটে চলে এই শহরের বুক চিরে—যাত্রীবাহী, পণ্যবাহী, এক্সপ্রেস কিংবা আন্তঃনগর—সব ট্রেনের ধুকপুক শব্দে জীবন্ত থাকে কুমিল্লার সকাল।
স্টেশনে ঢুকলেই শোনা যায় জীবনের সিম্ফনি—হকারদের ডাক, প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত যাত্রীদের মুখরতা, চা-ওয়ালার টুংটাং শব্দ, আর রেল ইঞ্জিনের গর্জন। আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় এখন কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন পেয়েছে নতুন চেহারা—ইলেকট্রনিক সাইনবোর্ড, অনলাইন টিকিটিং ব্যবস্থা, উন্নত নিরাপত্তা ও আলো ঝলমলে প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু এখনও পুরনো সেই গন্ধ মিশে আছে—কয়লার ধোঁয়া, পুরনো বেঞ্চের কাঠের ঘ্রাণ, আর ভোরবেলার শীতল শিশিরে ভেজা রেলের ধাতব ধ্বনি।
অন্যদিকে লাকসাম জংশন—বাংলাদেশ রেলওয়ের ইতিহাসে এক অনন্য নাম। একে বলা হয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেল জংশন। চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা ও খুলনা—চার দিকের রেললাইন এসে মিলেছে এখানে। প্রতিদিন শত শত ট্রেন এই জংশনে এসে থামে, ছুটে যায় আবার গন্তব্যে। বলা হয়, “যে রেলপথের বাঁশি বাজে লাকসামে, তার সুর পৌঁছে যায় পুরো পূর্বাঞ্চলে।”
লাকসামের রেলওয়ে শহরও গড়ে উঠেছে এই জংশনকে ঘিরে। শত শত কর্মচারী, পণ্যবাহী ট্রেনের শ্রমিক, হকার, খাবার দোকানদার—সবাই মিলে যেন এক জীবন্ত শহর। রাতের বেলায়ও লাকসাম ঘুমায় না। ট্রেনের হুইসেল, রেল ইঞ্জিনের আলো, আর কর্মব্যস্ত মানুষের চলাচল—সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর দৃশ্য তৈরি করে।
বর্তমানে সরকার “দ্বৈত লাইন ও ডাবল গেজ” প্রকল্পের মাধ্যমে কুমিল্লা-লাকসাম-চট্টগ্রাম রুটে ব্যাপক উন্নয়ন কাজ চালাচ্ছে। এর ফলে ট্রেন চলাচল আরও দ্রুত, নিরাপদ ও আরামদায়ক হচ্ছে। ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে এই পথ এখন এক আনন্দময় যাত্রার প্রতীক।
কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনের এক বৃদ্ধ চা-ওয়ালার ভাষায়, “রেলই কুমিল্লার প্রাণ। এই রেলের আওয়াজে মানুষ ঘুমায়, আবার জাগে।” সত্যিই তাই—কুমিল্লা ও লাকসামের রেল শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি ইতিহাসের, অনুভূতির, আর জীবনের গল্প।
বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় কুমিল্লা ও লাকসাম আজও ঐতিহ্যের দুই দণ্ড। একদিকে পুরনো শহরের সৌন্দর্য, অন্যদিকে আধুনিক রেল জংশনের গতি—দুয়ে মিলে তৈরি করেছে এমন এক সুর, যা বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে নিরন্তর বাজছে অবিরাম।